ই-বুক রিডার, নামটা শুনলেই আমাদের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে আস্ত একটা লাইব্রেরী, ঠিক যেন হাতের মুঠোয় এঁটে আছে! এই “E-Book” নামকরন হলো কিভাবে, কেন হলো? এফ-বুক না হয়ে ই-বুক কেন হলো, কবে থেকে এসবের শুরু; আসুন সবকিছু নিয়ে একটু খোশগল্পে মেতে উঠি আগামী ৫ মিনিট!
গল্পের শুরুটা ২০০০ এর দিকে, যখন কিনা আমেরিকাতে ই-বুক এবং ই-বুক রিডার দুটোরই প্রচলন ঘটে ব্যাপকভাবে, যা কিনা ২০১০ এর দিকে হার্ড-কপি বইয়ের সিংহভাগ মার্কেট শেয়ার দখল করে নেয়। কিন্তু কেন? কেন মানুষ ই-বুকের দিকে ঝুঁকেছে?
![]() |
ইলেকট্রনিক বুক কাকে বলে? ই-বুক কী? ই-বুক রিডার এর ইতিহাস |
প্রধান কয়েকটি কারন যদি উল্লেখ করতে হয়, তাহলে-
- সুলভমূল্যঃ একটা স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেট পিসির চেয়ে অনেকাংশেই কম দামী হয়ে থাকে ই-বুক রিডার!
- আরামদায়কঃ ই-বুক রিডারের স্ক্রিণ বই পড়ার জন্য আরামদায়ক, কারন এতে কোনো ব্লু-লাইট থাকে না!
- বিশাল লাইব্রেরীঃ বিশেষত ইংরেজী ছাড়াও অন্যান্য ভাষাতে ইলেক্ট্রনিক বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহশালা রয়েছে ইন্টারনেটে।
- বুকমার্ক/সহজলভ্যতাঃ আপনি চাইলে ই-বুকের যেকোন পেইজ বা লাইনকে সহজেই মার্ক করতে পারবেন, চাইলে নিজের কোনো মন্তব্যও জুড়ে দিতে পারবেন!
মোটকথা তুলনামূলকভাবে কমদামে বেশি সুবিধাসম্পন্ন ডিভাইস হিসেবে ই-বুক রিডার বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও আধুনিকায়নের জোয়ারে আমরা সেলফজুড়ে বই রাখার চেয়ে একটা ই-বুকে হাজার হাজার বই রাখাটাকে বেশি প্রেফার করি। জায়গা কমেছে, কিন্তু বেড়েছে সংগ্রহের সংখ্যা এবং সহজলভ্যতা।
এবার আসা যাক নামকরণে! ই-বুককে কতো নামে ডাকা হয় জানেন? কম করে হলেও ৭ ভাবে রেকগনাইজ করা হয় একে যেমন- ebook, eBook, “Ebook, e-Book, e-Journal, Digital Book! এত এত নামের ভিড়ে eBook/eBooks হিসেবেই গ্রাহকরা একে চিনে এবং ডেকে থাকেন। উইকির ভাষায় যার অর্থ – “an electronic version of a printed book”
ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান দেখে নেয়া যাক! মাত্র ২০১৩ সালেই আমেরিকাতে ই-বুক ছিলো মোট বইয়ের মার্কেট শেয়ারের ২৩%, তখন আমেরিকানদের হাতে ছিলো ৩০% ই-বুক রিডার। আর ২০১৪ তে সেই সংখ্যা বেড়েছে! ২৮% ই-বুকের বিপরীতে ৫০% ই-বুক রিডার হাতে চলে আসে আমেরিকানদের হাতে। জনপ্রিয়তার অংকটা জাপানের ড্রেইনের মতো পরিষ্কার !
কিভাবে এই ই-বুকের যাত্রা শুরু হলো ? কিভাবেই বা এই কন্সেপ্ট মার্কেটে এলো, কিভাবে কি হলো? আচ্ছা সবই বলি এবার। ই-বুক তৈরীর ইতিহাসটা একটু ঘোলাটে। কারণ কোনো একজনকে ই-বুক তৈরীর কারিগর বলা যায় না। কয়েকজনের নাম উল্লেখযোগ্য-
- Roberto Busa: একজন ইটালিয়ান খ্রিষ্টান পুরোহিত, যিনি কি না “index thomisticus” নামক একটা ইলেক্ট্রনিক বই লিখেছিলেন ১৯৪৬ থেকে ১৯৭০ সাল অব্দি, যা পরর্তীতে ডিস্ট্রিবিউট হয়েছিলো ১৯৮৯ তে, আর প্রথমবার অনলাইনে এসেছিলো ২০০৫ সালে।
- Angela Ruiz Robes : পেশায় একজন শিক্ষিকা, যার অবস্থান ছিলো স্পেইনের ফেরোলে। তিনি সবসময় চেয়েছিলেন স্কুল-কলেজে যেন কম কম বই বহন করা লাগে, আর তাই শুরুটা করেছিলেন “Encyclopaedia Mechanica aka. Mechanical Encyclopaedia” ইলেক্ট্রনিক বই লিখে।
- Douglas Engelbart : ১৯৬০ সালে Stanford Research Institute (SRI) তে “Hypertext Editing” আর “FRESS Project” এর আন্ডারে ই-বুকের আরোও উন্নতি সাধনের জন্য কাজ করেন, তা পরবর্তীতে এগিয়ে নিয়ে যান Adreis Van Dam।
- Michael S. Hart : ভদ্রলোক যা করছেন তা হলো আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ই-বুক আকারে প্রকাশ করেন ১৯৭১ সালে।
- Paul Baim : ১৯৯৩ সালে HyperCard নামক একধরনের ই-বুক রিডার নিয়ে আসেন, যাতে প্রথমবার “eBook” কথটা ব্যবহৃত হয়। এই ডিভাইসের বৈশিষ্ট্য ছিলো আপনি যেখানে পড়ছিলেন, সেখানেই আপনাকে পরবর্তীতে ফিরিয়ে আনতে পারতো! ২৭ বছর আগে এটাও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিলো।
আচ্ছা, ই-বুক তো নানারকমেরই হয় ! অর্থাৎ ফরম্যাট তো হরেক রকম ! একবার নামগুলো জেনে নিলে কেমন হয় ?
- Adobe PDF : সবথেকে বহুল ব্যবহৃত ই-বুক ফরম্যাট বর্তমান বিশ্বে, হয়তো আপনিও কখনও না কখনও PDF পড়েছেন।
- Text Encoding Initiative (TEI) : ১৯৯০ তে মার্কেটে এসেছিলো ফরম্যাটটি, যা জনপ্রিয়তা না পেলেও অন্যদের পথ দেখিয়েছিলো অবশ্যই।
- Open eBook : ৯০ এর দশকে এক নতুন ধরনের ফরম্যাট মার্কেটে আসে যাতে ছিলো xHTML আর CSS ল্যাঙ্গুয়েজ, যা পরবর্তীতে ePUB নামে মার্কেটে রয়ে গেছে।
আর ডিভাইসের সাথে সাথে নতুন নতুন অনেক ফরম্যাটও মার্কেটে রাজত্ব ফলিয়েছে-
- Amazon Kindle : সবথেকে ব্যাপকভাবে বিক্রিত ই-বুক রিডার, যার জন্য আলাদা ফরম্যাটের (AZW, AZW3, KF8, non-DRM mobi, PDF, PRC, TXT) ই-বুক প্রকাশিত হয়ে থাকে। Kindle এর পরেই Amazon এর জনপ্রিয় প্রোডাক্ট আরেকটি রয়েছে, নাম Fire ট্যাবলেট !
- Barnes & Noble Nook : ট্যাবলেট ধরনের মাল্টিপারপজ এই ই-বুক রিডারের ফরম্যাট দেখা যায় ePUB, PDF
- Apple iPad : অ্যাপেল মানেই তো আলাদা কিছু, তাদের ফরম্যাটও ভিন্ন (ePUB, IBA – MultiTouch books made via iBooks Author, PDF)
- Sony Reader : একটু বন্ধুসুলভ আচরনের SONY কিন্তু বেশ কয়েকটি চলতি ফরম্যাটই সাপোর্ট করে (ePUB, PDF, TXT, RTF, DOC, BBeB)
- Kobo eReader & Kobo Arc : ePUB আর PDF সহ আরও সাপোর্টেড এতে TXT, RTF, HTML, CBR, CBZ (comic)
- Android Devices with Google Play Books : এইতো, আমাদের কাঙ্খিত প্রোডাক্ট, কিন্তু অতটাও জনপ্রিয় নয় এইটা ! শুধুমাত্র ePUB আর PDF সাপোর্টেড
- Pocketbook Reader আর Pocketbook Touch : ডজনখানেক ফরম্যাটে সাপোর্টেড ! শুনবেন ? ePUB, ePUB DRM, PDF, PDF DRM, FB2, FB2.ZIP, TXT, DJVU, HTM, HTML, DOC, DOCx, RTF, CHM, TCR, PRC, PRC mobi !
জুলাই ২০১০ এ Amazon Kindle ই-বুক রিডার বিক্রি শুরু করে, জানতেন এটা? তখন সেই বছরেই অ্যামাজনে প্রতি ১০০ হার্ড কপি বই বিক্রির বিপরীতে ১৪০টি করে Kindle বিক্রি হচ্ছিলো। আর সেটা জানুয়ারী ২০১১ তে হার্ডকপি বিক্রিতে Kindle ছাড়িয়ে যায় বহুদূর। আমেরিকান পাবলিশিং অ্যাসোশিয়েশন অনুসারে আমেরিকাতে মোট বই বিক্রির ৮.৫% দখল করে আছে ই-বুক।
যদিও বাংলাদেশে এর তেমন ব্যবহার নেই, তারপরও এর সুবিধাগুলো তো অস্বীকার করা যায় না! একটা এভারেজ বইয়ের সাইজের ই-বুক রিডারে আপনি চাইলে লাখ লাখ বই স্টোর করে রাখতে পারবেন। যা কিনা একজন বই প্রেমীর জন্য আজীবনের খুশির খোরাক। তাছাড়া আপনি অল্প আলোতেও খুব ভালোভাবে পড়তে পারবেন। ব্লু লাইট না থাকায় চোখের ক্ষতি করবে না। ফন্ট ছোট-বড় করে নিতে পারবেন। এমনকি বই পড়েও দেয় অনেক ই-বুক রিডার ! সার্চ অপশন আপনার সময় বাঁচাবে। ডিকশিনারি থাকছে এতে। যা আপনার পড়ার গতি আরও বাড়িয়ে তুলবে।
একটা সাধারন ই-বুক রিডার বানাতে যা খরচ হয়ে থাকে, একটা সাধারন বই ছাপানোর খরচের সমান। অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম। কিন্তু সুবিধা হচ্ছে আপনি লাখ লাখ পাতা কাগজ বাঁচাতে পারলেন। আর বই গুছিয়ে রাখবার জন্য ই-বুক রিডার দারুণ অপশন। রিডিং লোকেশন, হাইলাইটস, বুকমার্ক ইত্যাদি নানানরকম ফিচারে ঠাসা ই-বুক রিডার।
আর যদি ডিজঅ্যাডভ্যান্টেজগুলোর কথা বলি, তাহলে তো প্রথমেই আসবে প্রাইভেসি ইস্যু। আপনি যদি অ্যামাজনের Kindle পড়েন, তাহলে অ্যামজন জানবে যে আপনি কে, কোথায় থাকেন, কি পড়ছেন, কোন পাতা পড়ছেন, কোন পাতা কতক্ষণ ধরে পড়েছেন, আপনি কোন লাইন বা প্যাসেজ হাইলাইট করেছেন ইত্যাদি। তাছাড়া এখনও একটা বড় সংখ্যক পাঠকেরা প্রিন্টেড মিডিয়াতেই বিশ্বাসী এবং স্বাচ্ছন্দ্যে হার্ড কপিই পড়তে চান তারা। এছাড়া Kobo-র এক রিসার্চে উঠে এসেছে যে 60% ই-বুক ক্রেতা শেষ অব্দি বইটি কখনোও পড়েননি।
এ বিষয়ে লেখক Joe Qeenan লিখেছেন, ই-বুক হলো তাদের জন্য যারা কিনা এতে থাকা তথ্যের কদর করে থাকে বা যারা রাস্তায় চলতে চলতে পড়তে পছন্দ করেন, যার দৃষ্টিজনিত কোনো সমস্যা আছে বা অন্যকে জানতে দিতে চান না যে তিনি নিজে কি পড়ছেন। অথবা যাদের ব্যাগে জায়গা কম একাধিক বই ক্যারি করার জন্য, তাদের জন্য ই-বুক। তবে যারা হার্ড কপি বইয়ের সাথেই বেড়ে উঠেছেন, এবং যাদের কাছে বই পড়ার জন্য হার্ড কপি বই একটা পরিবেশ তৈরী করে তোলে, তাদের জন্য ই-বুক একদমই ইউজলেস।
বই একটা আবেগের নাম, একটা ভরসার জায়গা। বই- যা কিনা আমরা ধরতে পারি, ছুঁতে পারি। নতুন বইয়ের একটা আলাদা সুঘ্রাণ থাকে। টাকা দিয়ে একটা বই কিনেছি, হাতে বইটা থাকবে- এটাই অধিকাংশ পাঠক চাইবেন। কিন্তু প্রযুক্তির আধুনিকায়নের সাথে সাথে ই-বুকের চাহিদাও বেড়েছে অনেকাংশে। আপনি কি ভাবছেন?
নতুন কাগজের ঘ্রাণ, বইয়ের শক্ত মলাট? নাকি ৭ ইঞ্চির একটা ডিভাইসে হাজার হাজার বইয়ের তালিকা? শেয়ার করতে পারেন সবার সাথে!